ব্রেস্ট কান্সারের চিকিৎসার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেঃ
১। অপারেশন (সার্জারি)
২। ঔষধ (কেমোথেরাপি, হরমোনাল থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি)
৩। রেডিওথেরাপি।
ক্যান্সারের গতি প্রকৃতি অনুযায়ী চিকিৎসকরা একাধিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারন করে থাকেন। যেমন অপারেশন এবং তারপর কেমোথেরাপি এবং/অথবা রেডিওথেরাপি অথবা অপারেশনের আগে বা পরে কেমোথেরাপি/রেডিওথেরাপি দেয়া হতে পারে।
১। অপারেশন (সার্জারি)1
প্রাথমিক (প্রাইমারী) ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সার্জারি হচ্ছে চিকিৎসার প্রথম ধাপ। টিউমারটির আকৃতির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক সার্জারির মাধ্যমে টিউমার ও তার আশেপাশের কিছু সুস্থ টিস্যু অপসারন করেন।
চিকিৎসক সাধারণত দুটি উপায়ে অপারেশন করে থাকেন
◆ ব্রেস্টে ক্যান্সারের অংশটুকু অপসারন (লাম্পেকটমি)
◆ সম্পূর্ণ ব্রেস্ট অপসারন (মাস্টেকটমি)
অপারেশনের সময়, যদি কোন লসিকা গ্রন্থিতে ক্যান্সার থেকে থাকে সার্জন সাধারণত সেটিও অপসারন করে থাকেন।
সার্জারির পরে একজন ক্যান্সার রোগীর জীবন6
ব্রেস্ট ক্যান্সার এ আক্রান্ত হবার দুঃসংবাদটা নেয়া বেশীরভাগ রোগী এবং তার স্বজনদের জন্য কঠিন। এ সময় প্রয়োজন হয় প্রিয়জনের পাশে থাকা এবং দৃঢ় মনোবল যা কিনা সাহায্য করতে পারে একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্যান্সার চিকিৎসার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে।
প্রাথমিক মানসিক আঘাতের পর একজন রোগী সর্বপ্রথম যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তা হল সার্জারি পরবর্তী নতুন দেহাকৃতির সাথে মানিয়ে নেয়া। সার্জারি পরবর্তী প্রথম কয়েক মাস অনেক সময় রোগী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। বিশেষত সার্জারির চিহ্ন এবং পাশ্বপ্রতিিয়া গুলো তাকে তাড়া করে ফেরে। এ সময় মানসিক সাহায্যের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় বিশেষ কিছু ব্যায়াম এবং উপযুক্ত সুষম খাদ্যের। শারীরিকভাবে সেরে উঠার জন্য যে ব্যায়ামগুলো প্রয়োজন তার কোনটাই কঠিন কিছু নয়। নিয়মিত ও সঠিকভাবে নিচের শারীরিক কসরতগুলো করলে তা আপনাকে এ নতুন অবস্থায় মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
ব্যায়াম এর নিয়মাবলী7
সার্জারির প্রথম সপ্তাহ পর
ওয়ার্ম আপ এবং কুল ডাউন ব্যায়াম করুন। এর মধ্যে রয়েছে এক ও দুই নম্বর ব্যায়াম গুলো।
দ্বিতীয় সপ্তাহ ও পরবর্তীতে
ওয়ার্ম আপ, বেসিক, এ্যাডভান্স এবং কুল ডাউন ব্যায়ামগুলো করুন। ব্যায়ামের সময়কাল একটি দিক নির্দেশনা হিসাবে দেয়া হয়েছে এবং আপনি আপনার নিজস্ব গতিতে ব্যায়াম করতে পারেন।
◆ আপনি সার্জারির পরের দিন থেকে ব্যায়াম করতে পারেন
◆ প্রতি ব্যায়াম এর মাঝে ৫ মিনিট বিরতি দিন
◆ দিনে তিনবার ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন তা হতে পারে সকালে, দুপুরের কোন সময় এবং বিকালে।
আপনার ব্রেস্ট সার্জারি হয়ে থাকলে ব্যায়াম শুরুর আগে আপনার চিকিৎসক বা ফিজিওথেরাপিস্ট এর সাথে কথা বলে নিন।
ব্যায়াম করার সময় আপনি ব্যাথা অনুভব করতে পারেন। মাংসপেশিতে কিছুটা টান অনুভব করা স্বাভাবিক। যদি আপনি নড়াচড়া বা ব্যায়াম করতে অস্বস্তিবোধ করেন তবে আপনার চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
ওয়ার্ম আপ ও কুল ডাউন ব্যায়াম
আপনি যে কোন ব্যায়াম শুরুর পূর্বে ১ ও ২ নং ব্যায়াম করে নিন এবং শেষে আবার তা করুন। আপনি দাড়িয়ে কিংবা বসে ব্যায়ামগুলো করতে পারেন।
১
কাঁধ সংকুচিত করা
● প্রথমে সমস্ত শরীর রিলাক্স করে নিন।
● কাঁধ সঙ্কুচিত করে কান বরাবর উঠান এবং একই ভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসুন।
২
কাঁধ বৃত্তাকারে ঘুরানো
● প্রথমে সমস্ত শরীর রিলা করে নিন।
● কাঁধ সঙ্কুচিত করে সামনের দিক দিয়ে কান বরাবর উঠান এবং ঘুরিয়ে পেছনের দিক হয়ে নিচে নামান।
বেসিক ব্যায়াম
সাধারণ ব্যায়াম আপনি সার্জারির এক সপ্তাহ পর থেকে করতে পারবেন। ব্যায়ামগুলো বসে বা দাড়িয়ে করতে পারবেন। তবে এগুলো করার পূর্বে ওয়ার্ম আপ ব্যায়ামগুলো করে নিন। ব্যায়ামগুলো করার সময় খেয়াল রাখবেন হাত যেন কাঁধের (৯০ ডিগ্রীর) উপর উঠে না যায়।
৩
বাহু নত করা
● দুই হাত উপরে উঠান এবং দেহের সামনের দিকে রাখুন।
● কনুই ভাঁজ করে আলতোভাবে হাত কাঁধের উপর রাখুন।
● এখন ধীরে ধীরে কনুই নিচের দিকে আনুন আর উপরে উঠান।
বিকল্প পদ্ধতি
● দুই হাত উপরে উঠান এবং দুই দিকে প্রসারিত করুন।
● কনুই ভাঁজ করে আলতোভাবে হাত কাঁধের উপর রাখুন।
● এখন ধীরে ধীরে কনুই নিচের দিকে আনুন এবং উপরে উঠান।
৪
পিছনে আঁক কাটা
● হাত দুটো দুই দিকে প্রসারিত করুন এবং কনুই বাঁকা করে নিচের নিন।
● এবার দু হাতকে কাঁধের হাড়ের নিচের দিকে মিলিত করুন।
৫
কনুই উপরে উঠানো
● আপনার হাত দুটো মাথার পেছনে স্থাপন করুন এবং কনুই দুটো মুখের সামনে একত্র করুন।
● হাত দুটো একই স্থানে রেখে কনুই দুপাশে প্রসারিত করুন এবং আবার একই অবস্থানে ফিরিয়ে আনুন।
আরও কিছু এ্যাডভান্স ব্যায়াম
সার্জারীর দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে আপনি এই ব্যায়ামগুলো শুরু করতে পারেন (যদি আপনার সেলাই বা নল অপসারণ না করে তবে অপেক্ষা করুন)। এই ব্যায়াম করার সময় আপনার হাত অবশ্যই কাঁধের উপর পর্যন্ত নিয়ে যাবেন।
অবশ্যই ওয়ার্ম আপ করার কথা ভুলবেন না। যদি আপনার ঘাঁ না শুকিয়ে থাকে, ইনফেকশন থাকে বা ব্যথা অনুভব করেন তবে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬
দেয়াল বেয়ে উঠা
● সোজা হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ান।
● কাঁধ বরাবর দেয়ালে দুই হাত রাখুন।
● সোজা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে হাত আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠান।
● আঙ্গুল ব্যবহার করে হাতকে উপরে উঠাতে পারেন এবং যতক্ষণ ব্যাথা অনুভব করবেন না ততক্ষণ সর্বোচ্চ উচ্চতা পর্যন্ত উঠাতে চেষ্টা করুন।
● হাত উপরে উঠানোর পর সেখানে ধরে রাখুন এবং ১০ পর্যন্ত গণনা করুন।
● একইভাবে হাত দুটোকে আস্তে আস্তে আগের অবস্থানে নিয়ে আসুন।
● প্রতিবার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠানোর চেষ্টা করুন।
● এবার একপাশ হয়ে দেয়ালে কাছাকাছি দাঁড়ান।
● কাঁধ স্বাভাবিক রেখে কনুই নিচের দিকে নিয়ে হাত দেয়ালের উপর রাখুন
● সামনের দিকে তাকিয়ে হাতটি আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠান এবং কনুই সোজা করার চেষ্টা করুন।
● উপরে উঠানোর পর স্থির হন এবং ১০ পর্যন্ত গণনা করুন।
● ধীরে ধীরে হাতকে আবার পূর্বের অবস্থানে নিয়ে আসুন।
৭
হাত উপরে উঠানো
● মেঝে কিংবা বিছানায় শুয়ে পড়ুন এবং স্বাভাবিক থাকার জন্য মাথার নিচে কুশন বা বালিশ দিন।
● শুয়ে পড়ার পর তিন থেকে চারবার লম্বা নিঃশ্বাস নিন।
● কাঁধকে স্বাভাবিক রাখুন যেন কানের নিচে ভাঁজ না হয়ে যায়।
● দুই হাত একসাথে মুষ্টিবদ্ধ করুন। কনুই সোজা রেখে হাত মাথার উপরে নিয়ে যান এবং অসুবিধা না হওয়া পর্যন্ত মাথার পিছনের দিকে নামাতে থাকুন।
● স্থির হয়ে থাকুন ও ১০ পর্যন্ত গণনা করুন তারপর হাতকে আগের অবস্থানে নিয়ে আসুন।
বিকল্প
● যদি আপনার শুয়ে থাকতে অসুবিধা হয় বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন তবে ব্যায়ামগুলো বসা অবস্থায় পেছনের দিকে হেলে করতে পারেন।
৮
কনুই ঠেলা
● পেছন দিক হয়ে শুয়ে হাতদুটো মাথার পেছনে রাখুন এবং কনুই দুটোকে দুদিকে প্রসারিত করুন।
● এবার কনুই দুটোকে মেঝে বরাবর নিচের দিকে নামান যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অসুবিধা অনুভব না করেন।
● নিচের দিকে নামানোর পর স্থির হন এবং ১০ পর্যন্ত গুণুন। যে সকল রোগীকে রেডিওথেরাপী দেয়া হয় তাদের জন্য এই ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ থেরাপী দেয়ার সময় একইভাবে রোগীকে শোয়ানো হয়।
আয়নায় নিজের মুখ6
সার্জারি পরবর্তী নিজের দেহের নতুন গড়নের সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই মনোবিদরা সার্জারির ঠিক পরেই রোগীকে আয়নার সামনে দাঁড়াতে নিষেধ করেন। দুই থেকে তিন দিন পর যখন রোগী কিছুটা ধাতস্ত হন তখন তার আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত। সেলাই ও কাটার দাগ দেখে ভীত হবার কিছু নেই। মনে রাখতে হবে একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য এটা একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। আপনি যদি রোগী হন তাহলে পাশে রাখুন তাকে যিনি আপনাকে সাহস দিতে পারবেন আর যদি আপনি রোগীর স্বজন হন তাহলে পাশে থাকুন তার যাতে আপনি তাকে সাহস যোগাতে পারেন।
কথা বলুন সহযোদ্ধাদের সাথে6
এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা কেবল মাত্র আক্রান্তরাই অনুধাবন করতে পারেন। তাই সার্জারি এবং তার পরবর্তী চিকিৎসা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আর এ থেকে উত্তরণের উপায়গুলো জানার জন্য কথা বলুন তার সাথে যাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সার্জারির পরে রোগীদের মনে প্রায়শই এ প্রশ্ন আসে যে, টিউমার তো শরীরে নেই তাহলে কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির প্রয়োজন কেন? সার্জারির পরে কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির উদ্দেশ্য সাধারণত দুটি। প্রথমত, অনেক সময় চিকিৎসকের পক্ষে সম্পূর্ণ টিউমার অপসারণ সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়ত, ক্যান্সার পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা। এ দুটো কারণে চিকিৎসক দীর্ঘমেয়াদী কেমোথেরাপি এবং/অথবা রেডিওথেরাপি প্রেস্ক্রাইব করেন।
২. রেডিওথেরাপি8
রেডিওথেরাপি উচ্চ-শক্তির এক্স-রে ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করে। প্রায় ক্ষেত্রেই অপারেশন এর পর ক্ষত শুকিয়ে গেলে রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। এটি ক্যান্সার পুনরায় ফিরে আসার ঝুঁকি কমায়।
৩. কেমোথেরাপি9
কেমোথেরাপিতে ক্যান্সারের কোষগুলোকে ধ্বংস করার জন্য ক্যান্সার বিরোধী (সাইটোটক্সিক) ঔষধ ব্যবহার করা হয়।
৪. টার্গেটেড থেরাপি17,18
কেমোথেরাপি এবং হরমোনাল থেরাপি ছাড়াও নতুন আরও কার্যকর চিকিৎসা হল টার্গেটেড থেরাপি যা স্বাভাবিক কোষগুলোর ক্ষতি না করে নির্দিষ্ট কোষ ধ্বংস করতে পারে। এছাড়াও ক্যান্সারের বৃদ্ধি বা দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে পারে।
কখনও কখনও টার্গেটেড থেরাপি সেই সকল জায়গায় কাজ করে যেখানে কেমোথেরাপি কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। টার্গেটেড থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমোথেরাপির তুলানায় সীমিত। ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে ১ জন নারীর বিশেষ প্রোটিন এইচইআর২ (HER2) পজিটিভ থাকে এবং এ ধরনের ক্যান্সার অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় আগ্রাসী হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রোটিনকে লক্ষ্য করে অনেক ধরনের টার্গেটেড থেরাপি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রাস্টুজুমাব, পারটুজুমাব, ট্রাস্টুজুমাব এমটানসিন, ল্যাপাটিনিব ইত্যাদি।