বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অক্সিজেন প্রয়োজন যা বাতাসে পাওয়া যায়। এই অক্সিজেন মানুষের দেহে নাকের মাধ্যমে প্রবেশ করে ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায় এবং ফুসফুস সেই অক্সিজেন সারা দেহে ছড়িয়ে দেয়। এখানে নাক এবং ফুসফুস, শ্বসনতন্ত্রে র অংশ হিসেবে কাজ করে। ফুসফুস অ্যালভিওলিতে কৈশিক নালির (গুরুত্বপূর্ণ ছোট ছোট কোষ) মাধ্যমে অক্সিজেনেটেড ব্লাড (অক্সিজেন মিশ্রিত রক্ত) এবং ডি-অক্সিজেনেটেড ব্লাড (অক্সিজেন বিহিন রক্ত) আদান প্রদান করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি মিনিটে ১২ থেকে ২০ বার শ্বাস নেয়, এর থেকে বেশি বা কম নিলে সেটা অস্বাভাবিক। ফুসফুসের গঠনে কোন প্রকার পরিবর্তন হলে , তা অক্সিজেনের সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে যা মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
ফুসফুসের ক্যানসার একটি নীরব কিন্তু আক্রমণাত্মক ব্যাধি। ফুসফুস কোষ সমূহের অতিরিক্ত অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ফুসফুসের স্বাভাবিক গঠন এবং কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দেয়। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পরে টিউমারে পরিণত হয়। এই টিউমার মানব দেহে অক্সিজেন প্রবাহে বাঁধা প্রদান করে, যা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।
ফুসফুসের ক্যানসার এমন একটি রোগ যা কোন ধর্ম, বর্ণ, জাতি মানে না। দিন যত যাচ্ছে, আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এই ক্যানসার এর ফাঁদে পরে যাচ্ছে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করে ফুসফুসের ক্যানসারের কারণে। মূত্রথলী, কলোরেক্টাল এবং ব্রেস্ট ক্যানসারের কা রণে মৃত্যু বরণ করা মানুষের সংখ্যা ফুসফুসের ক্যানসারের কারণে মৃত্যু বরণ করা মানুষের থেকে কম। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আক্রান্ত সকল ক্যানসার রোগীদের ৮.২% রোগী ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, যদিও শুনতে অনেক কম শোনায় কিন্তু এর সংখ্যা প্রায় ১২,৩৭৪ জন।
মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই সতর্কবাণী দেয়। যদিও ফুসফুসের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এ সকল লক্ষণ অনেক ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং অধিকাংশ সময় তা উপেক্ষা করা হয় যে সকল লক্ষন প্রকাশ পেতে পারে-
এই লক্ষন গুলো কারও শরীরে প্রকাশ পাওয়া মানেই যে মানুষটি ফুসফুস এর ক্যানসারে আক্রান্ত তা নয় কিন্তু লক্ষন গুলো প্রকাশ পাওয়া মাত্রই একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নেয়া উচিৎ।
তামাক- যে ভাবেই সেবন করা হোক না কেন, চিবিয়ে কিংবা ধূমপান করে, তা ফুসফুসের ক্যানসারের কারণ হতে পারে। ধূমপানের কারণে ৮০% মানুষ ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়।
অনেকের ধারনা যে ধূমপান না করলে ফুসফুস ক্যানসার দ্বারা আক্রান্ত হবে না, কিন্তু সবসময় তা সত্য নাও হতে পারে। ফুসফুসের ক্যানসারের প্রধান কারণ হল ধূমপান করা।
রেডিয়েশন- যাদের রেডিয়েশন দ্বারা চিকিৎসা নিতে হয়, তাদের ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পেশাগত কারন কিংবা কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকির কারনে- অ্যাসবেসটস এবং বিভিন্ন কারসিনোজেনিক (যে সকল বস্তু ক্যানসার ঘটায়) বস্তু সাবধানতার সাথে ব্যবহার না করলে ক্যানসার এর ঝুঁকি বেরে যায়।
শহরের বায়ু দূষণ- গ্রামাঞ্চলের বাতাস থেকে ব্যস্ত শহরের বাতাসে ক্ষুদ্র কণা বেশি পাওয়া যায় যা ফুসফুসের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এই সকল ক্ষুদ্র কণাও ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
ঘরের ভিতরে বায়ু দূষণ- যে সকল ঘরে নিম্ন মানের বায়ু সঞ্চালন ব্যবস্থা আছে, যার ফলে কাঠ পোড়ানো ধোঁয়া বের হতে পারে না কিংবা যে সকল বাসায় ধূমপায়ী ব্যক্তি থাকে, ঐ সকল বাসার বাসিন্দাদের ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অধিক।
অন্যান্য ফুসফুসের রোগ- ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার (COPD), যক্ষ্মা, এমফিসেমা ইত্যাদি রোগ ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যদি পূর্বে পরিবারের কারও ক্যানসার হয়ে থাকে, তাহলে বাকিদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ফুসফুসের ক্যানসার কে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার (এনএসসিএলসি) এবং স্মল সেল লাং ক্যানসার (এসসিএলসি)। স্টেজিং বা পর্যায় বলতে বোঝায়, ক্যানসার কতটুকু সংক্রমিত হয়েছে, এটি কি লোকাল অর্থাৎ একটি ছোট জায়গায় আবদ্ধ, সম্পূর্ণ ফুসফুসে ছড়িয়ে গেছে নাকি দেহের অন্যান্য গ্রন্থি এবং লিম্ফ নোডেও (লসিকা) ছড়িয়ে গেছে।
৮৫% ফুসফুসের ক্যানসার নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার হিসেবে সনাক্ত হয়।6, 7. যে সকল মানুষ ধূমপান করে বা দূষিত পরিবেশে কাজ করে তাদের এনএসসিএলসি তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
স্টেজ ১ বা প্রথম পর্যায়- ক্যানসার শুধুমাত্র ফুসফুসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
স্টেজ ২ বা দ্বিতীয় পর্যায়- ক্যানসার ফুসফুস এবং নিকটবর্তী লিম্ফ নোডে বিদ্যমান (লিম্ফনোড, রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থার অংশ, এদের কাজ হল লিম্ফাটিক রস পরিশোধন করা) ।
স্টেজ ৩ বা তৃতীয় পর্যায়- ক্যানসার সম্পূর্ণ ফুসফুস এবং নিকটবর্তী লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে গেছে। যদি ক্যানসার ফুসফুসের এক পাশেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে সেটি স্টেজ ৩এ এবং যদি দুই পাশেই ছড়িয়ে যায় তাহলে তা স্টেজ ৩বি।
স্টেজ ৪ বা চতুর্থ পর্যায়- এটি একদম শেষ পর্যায় যখন ফুসফুস, লিম্ফ নোড সহ দেহের অন্যান্য গ্রন্থিতেও ক্যানসার ছড়িয়ে গেছে।
স্মল সেল লাং ক্যানসার লিমিটেড (সিমাবদ্ধ) এবং এক্সটেন্ডেড (বিস্তৃত), এই দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। লিমিটেড স্টেজে বা পর্যায়ে ক্যানসার ফুসফুসের এক পাশে এবং নিকটবর্তী লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়ে। এক্সটেন্ডেড পর্যায়ে ক্যানসার দেহের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে যার অপর নাম মেটাস্ট্যাসিস।
রোগ নির্ণয়ের পর, ক্যানসার কোন স্টেজ বা পর্যায়ে আছে, চিকিৎসার ধরণ তার ওপর নির্ভর করে। সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, টারগেটেড থেরাপি কিংবা ইমিউনোথেরাপি এর যেকোনো একটি কান্সারের চিকিৎসা হতে পারে। চিকিৎসার ধরণ কি রকম হবে তা একজন অনকোলোজিস্ট (ক্যানসার বিশেষজ্ঞ) বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নির্ণয় করবেন। যেমন-স্পিউটাম সাইটোলোজি বা থুতু পরীক্ষা কিংবা সিটি, এমআরআই, পেট স্ক্যান, নিডল বায়োপসি এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে মলিকুলার টেস্টিং বা আণবিক পরীক্ষা। প্রতিনিয়ত চিকিতসকেরা তাদের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য, যাতে রোগীদেরকে সেরা চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়।